তারিখ : ২৮ মার্চ ২০২৪, বৃহস্পতিবার

সংবাদ শিরোনাম

বিস্তারিত বিষয়

রাণীনগরের পাঁচ জয়িতার জীবন যুদ্ধের আত্মগল্প

রাণীনগরের পাঁচ জয়িতার জীবন যুদ্ধের সফলতার আত্মগল্প
[ভালুকা ডট কম : ০৭ জানুয়ারী]
সমাজের এমন কিছু নারী রয়েছেন যারা প্রতিনিয়তই প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে জীবন যুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। কেউ কেউ সেই যুদ্ধে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছেন। কেউ কেউ সমাজের আর দশ জন নির্যাতিত ও অবহেলিত নারীদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নীরবে কাজ নীরবে কাজ করে যাচ্ছেন। কেউ কেউ শত বাধা-বিপত্তিকে পায়ে দলে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছেন। এমন সব নারীদের সাহসীকতার অবদান এবং ভালো কাজের স্বীকৃতি ও প্রেরণা দেওয়ার লক্ষ্যে সরকার ও বিভিন্ন সংগঠন প্রতিনিয়তই কাজ করে যাচ্ছে।

বর্তমান সময়ে আমাদের সমাজে এমন অসংখ্য নারী রয়েছে যারা নিজেদের মনোবল, ইচ্ছাশক্তি এবং কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে হয়ে উঠেছেন স্বাবলম্বী। আর এই সব নারীদের তৃণমূল পর্যায় থেকে উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত করার লক্ষে মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধিনে উপজেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর জীবন যুুদ্ধে জয়ী নারীদের স্বীকৃতি প্রদানের জন্য জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ শীর্ষক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে আসছে। দেশের এই সব অবহেলিত ও নির্যাতিত নারীদের সমাজের সামনে তুলে নিয়ে আসার লক্ষ্যে ২০১৩সাল থেকে সরকার চালু করেছে জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ নামক কার্যক্রম। তারই ধারাবাহিকতায় নওগাঁর রাণীনগরে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের জন্য মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে “জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ” কার্যক্রমের আওতায় আন্তর্জাতিক নারী প্রতিরোধ পক্ষ ও বেগম রোকেয়া দিবসে উপজেলার পাঁচ নারীকে জয়িতার পুরস্কার ও সংবর্ধনা প্রদান করা হয়েছে।

সংবর্ধনা উপলক্ষে উপজেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উদ্যোগে ও উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। উপজেলা পরিষদ অডিটোরিয়ামে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আল মামুনের সভাপতিত্বে ও মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা খন্দকার মাকাম্বাম মাহমুদার সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ছিলেন উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আলহাজ্ব আনোয়ার হোসেন হেলাল। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন ভাইস চেয়ারম্যান জারজিস হাসান মিঠু, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান ফরিদা বেগম, নির্বাচন কর্মকর্তা জায়িদা খাতুন, রাণীনগর শের-এ বাংলা সরকারি মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ মোফাখ্খার হোসেন খাঁন পথিক, রাণীনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জহুরুল হক, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান পিন্টু প্রমুখ। আলোচনা সভা শেষে অতিথিরা বিজয়ী জয়িতাদের হাতে সম্মাননা হিসেবে ক্রেস্ট তুলে দেন।

উপজেলার পাঁচ জয়িতারা হলেন শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী মোছা: চাঁদ আক্তার বানু, সফল জননী মোছা: শিরিনা বেগম, সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখার জন্য মোছা: পান্না বেগম, অর্থনৈতিক ভাবে সাফল্য অর্জনকারী মোছা: আফরোজা বেগম ও নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যোমে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে মোছা: রোমানা বেগম। এছাড়াও সফল জননী মোছা: শিরিনা বেগম জেলা পর্যায়েও শ্রেষ্ঠ হয়েছেন।

শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী জয়িতা মোছা: চাঁদ আক্তার বানু বলেন খুব কম বয়সে আমাকে বিয়ে দেওয়া হয় এক প্রবাসীর সঙ্গে। স্বামী ও আমার পরিবার কট্টোর ইসলামপন্থি হওয়ার কারণে বিয়ের পর পড়ালেখা একেবারেই বন্ধ হতে যাচ্ছিল। কিন্তু আমি শত বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে স্বামীর সহযোগিতায় লুকোচুরি করে পড়ালেখা অব্যাহত রাখি। উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্ন লালন করতাম আমার ভিতরে। যে করেই হোক না কেন আমাকে লক্ষ্যস্থলে পৌছাতে হবেই। আর এর জন্য আমাকে প্রতিনিয়তই স্বামীর ও নিজের পরিবারের গালমন্দ শুনতে হয়েছে। আজ আমি উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে আমার নানার সহযেগিতায় রাণীনগর সরকারি মডেল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকরী করছি। আমি আমার স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে পেরেছি বলে আমি অনেক খুশি। নারীরাও যে অনেক কিছু করতে পারে তা আমি সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছি।

সফল জননী মোছা: শিরিনা বেগম বলেন আমার স্বামী ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। মধ্যবিত্ত পরিবারে পাঁচ মেয়ে ও এক ছেলের পড়ালেখাসহ পুরো পরিবারের খরচ চালানো ছিলো আমাদের পক্ষে খুবই কঠিন একটি বিষয়। ছেলে-মেয়েরা স্বাবলম্বী হওয়ার আগেই স্বামী আমাদের ছেলে চলে যান। এরপর থেকে শুরু হয় আমার সংসার যুদ্ধের অধ্যায়। স্বামীর রেখে যাওয়া সামান্য জমি ও হার ভাঙ্গা পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে পাঁচটি মেয়ে ও একটি ছেলের পড়ালেখার খরচ যোগানো আমার পক্ষে খুবই দু:সাধ্য বিষয় ছিলো। তবুও হতাশ না হয়ে শত কষ্টেও সন্তানদের পড়ালেখা চালিয়ে নিতাম। এরপর আস্তে আস্তে মেয়েরা উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে চাকরী নিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করলো। বর্তমানে আমার ৩মেয়ে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা, এক মেয়ে বিসিএস পাস করে প্রশাসন ক্যাডারে ও এক মেয়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় রয়েছে। আর একমাত্র ছেলে প্রকৌশলী বিষয়ে অধ্যায়নরত রয়েছে। আশা করছি সেও ভালো একটি কর্ম পেয়ে যাবে। আমার জীবনের কষ্ট আজ পুরোটাই সৃষ্টিকর্তা সফলতায় পরিণত করেছে। আমার জীবনের আর কোন চাওয়া কিংবা পাওয়া নেই।

অর্থনৈতিক ভাবে সাফল্য অর্জনকারী জয়িতা মোছা: আফরোজা বেগম বলেন সমাজে অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও জীবন সংগ্রাম করে আর্থিকভাবে সফল হয়েছেন তিনি। এক সময় সংসারে অভাব আর অনটন সব সময় লেগেই থাকতো। দিনমজুর স্বামীর একক আয়ে সংসারের কোন সদস্যের প্রয়োজন পুরোটা মিটতো না। দিনের কোন না কোন বেলা তাদেরকে না খেয়ে থাকতে হতো। এমতাবস্থায় কিছু একটা করতে হবে সিদ্ধান্ত নেন আফেরোজা। এরপর মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর থেকে সেলাই কাজের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ঋণ নিয়ে কিনেন একটি সেলাই মেশিন। নিজ বাড়িতেই শুরু করেন সেলাই কাজ। এরপর আফরোজাকে আর পিছু ফিরে দেখতে হয় নাই। সেলাই কাজের পাশাপাশি শুরু করেন হাঁস-মুরগী পালন। এখন আফরোজার সংসার থেকে বিদায় নিয়েছে অভাব আর অনটন। অন্যরাও এতে উৎসাহিত হচ্ছেন। প্রবল মানসিক ইচ্ছাশক্তিতে বলিয়ান হয়ে আর্থিকভাকে সমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন জয়িতা আফেরোজা বেগম।

সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখা জয়িতা মোছা: পান্না বেগম বলেন নিঠুর গরীব পরিবারের আমার জন্ম। অভাব-অনটন ছিলো আমার জীবনের নিত্যসঙ্গি। অভাবের সংসারে বেশিদুর পর্যন্ত পড়ালেখা করা ভাগ্যে জোটেনি। এরপর বাবা-মা আমাকে বিয়ে দেয় এক দিনমজুরের সঙ্গে। সেখানে গিয়েও হাড় ভাঙ্গা খাটুনি করা শুরু হলো। এক পর্যায়ে আনসার-ভিডিপির প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। এরপর থেকে একটু পরিবর্তন আসতে শুরু করে আমার পরিবারে। কিন্তু আমার মতো অসহায় নারীদের দেখলে চেষ্টা করি তাদের কাজে সহায়তা করার। অনেক গ্রামের নারীরা কোন অফিসই ভালো ভাবে চিনে না আবার অনেক অফিসের লোকজনরা তাদেরকে পাত্তাই দেয় না। আমি উপজেলায় থেকে অফিসের কাজের ফাঁকে এই সব নারীদের কাজে সহযোগিতা করার চেষ্টা করি। চেষ্টা করি সমাজের অবহেলিত, অভাবী ও নির্যাতিত নারীদের জন্য কিছু করার জন্য। সেই সব নারীদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথ দেখাতে চেষ্টা করে আসছি। আর এভাবেই আমি আমার জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত সমাজের এই সব নারীদের জন্য উৎসর্গ করতে চাই।

নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যোমে প্রতিষ্ঠিত হওয়া জয়িতা মোছা: রোমানা বেগম বলেন বিয়ের পর থেকে স্বামী আর স্বামীর পরিবারের সদস্যদের যৌতুকের নির্যাতন লেগেই থাকতো। আমি ছিলাম গরীব পরিবারের মেয়ে। আমার পরিবার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছে আমার স্বামীকে উপঢৌকন দেওয়ার জন্য। তবুও আমার স্বামীর মন ভরতো না। আমার উপর নির্যাতন চলতোই। তবুও আমি আমার সন্তানদের দেখে চেয়ে সেই সব নির্যাতন মুখবুজে সহ্য করে যেতাম। কয়েক বছর আগে স্বামী জটিল রোগে আক্রান্ত হলে আমি ও আমার পরিবারের সদস্যরা সাধ্যমতো চেষ্টা করেছে তার চিকিৎসা করার জন্য। তবুও তাকে বাঁচানো যায়নি। এখন আমি দুই সন্তানকে নিয়ে কোন রকম জীবন-যাপন করছি। স্বামীর পাওয়া কিছু জমি-জমা আর আমার পরিবারের সহযোগিতায় দুটি সন্তানকে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণে চেষ্টা করে আসছি। সমাজে আমার দুটি সন্তানকে প্রতিষ্ঠিত করাই এখন আমার প্রধান লক্ষ্য।

উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা খন্দকার মাক্বামাম মাহমুদা বলেন জয়িতারা এই সমাজের পিছিয়ে পড়া অন্য নারীদের জন্য এক মহা দৃষ্টান্তর। তাদের খুজে বের করে সম্মানিত করা আমাদের নৈতিক দায়িত্বের একটি অংশ। তাই আমরা চেষ্টা করেছি এই জয়িতাদের ক্ষুদ্র হলেও সম্মানিত করার। আমাদের চেষ্টা আগামীতেও অব্যাহত থাকবে। তাই আমরা নারীদেরকে অবজ্ঞা আর অবহেলার দৃষ্টিতে না দেখে সমাজের সকল স্তরে তাদেরকে সকল ক্ষেত্রে সহযোগিতা প্রদান করি। এতে করে আমাদের সমাজই আরো শক্তিশালী হবে। দেশ আরো উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাবে।#



সতর্কীকরণ

সতর্কীকরণ : কলাম বিভাগটি ব্যাক্তির স্বাধীন মত প্রকাশের জন্য,আমরা বিশ্বাস করি ব্যাক্তির কথা বলার পূর্ণ স্বাধীনতায় তাই কলাম বিভাগের লিখা সমূহ এবং যে কোন প্রকারের মন্তব্যর জন্য ভালুকা ডট কম কর্তৃপক্ষ দায়ী নয় । প্রত্যেক ব্যাক্তি তার নিজ দ্বায়ীত্বে তার মন্তব্য বা লিখা প্রকাশের জন্য কর্তৃপক্ষ কে দিচ্ছেন ।

কমেন্ট

নারী ও শিশু বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

সর্বশেষ সংবাদ

অনলাইন জরিপ

  • ভালুকা ডট কম এর নতুন কাজ আপনার কাছে ভাল লাগছে ?
    ভোট দিয়েছেন ৮৯০৬ জন
    হ্যাঁ
    না
    মন্তব্য নেই